নতুন লক্ষ্যে আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড

নতুন লক্ষ্যে আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড

জুলাই মাসে আমাদের তোড়জোড় শুরু হয়। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে শুরু হয় আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড (আইএমও)। এর আগে আমরা খোঁজ শুরু করি ডিসেম্বর থেকে; উদ্দেশ্য—ছয়জন খুদে গণিতবিদকে বের করা, যারা আইএমওতে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে যাবে। একই রুটিন। তবে, বছর বছর লক্ষ্য বদলে যায়।

এই যেমন ২০০১ সালে এপ্রিলের কোনো একদিন কায়কোবাদ স্যার (অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ) ও জাফর ইকবাল স্যার (অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল) প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে দেখা করে পত্রিকার পাতায় গণিত অলিম্পিয়াড চালুর কথা বলেন। নিউরনে অনুরণন নামের সেই অভিনব অলিম্পিয়াড দীর্ঘদিন ধরে, মোট ৪০ সপ্তাহ চালু ছিল। এর মধ্যে কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনের মিলনায়তন থেকে আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড এ বছর পৌঁছে গেছে ৬৪ জেলার ৬৬টি কেন্দ্রে! সিএ ভবনের ১১৫ জন থেকে এবারের ৫০ হাজার! অন্যদিকে ২০০৫ সালে ৯১টি দেশের মধ্যে ৮৫ তম হয়ে আমরা শুরু করেছিলাম আইএমওতে পদচারণ। ১৪ বছরের মধ্যে সোনার পদকসহ আমাদের অর্জন অনেক। গত ২৫ বছরে যেসব দেশ আইএমওতে যুক্ত হয়েছে, সাফল্যের বিচারে আমরাই সেখানে সেরা! ডাচ্​–বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, প্রথম আলো, গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি, পুস্তক প্রকাশক, বন্ধুসভা, মুভার্স হয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী আর অভিভাবক—সবাই এই গৌরবের অংশীদার।

শুরু থেকে ডাচ্​বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসবের দুটো লক্ষ্য আমরা মাথায় রাখতাম। এর মধ্যে ক্ষুদ্রতরটি ছিল আইএমও থেকে পদক লাভ। আর বৃহত্তরটি অনেক বড় লক্ষ্য। গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজন করতে গিয়ে আমরা টের পাই আমাদের শিক্ষার্থীরা গণিতের প্রকৃত রস-আস্বাদন করতে পারছে না। পাঠ্য গণিতের ছোট্ট জগতে আটকা পড়েছে, অনুশীলনী করতে গিয়ে প্রকৃত সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।

কাজেই আমরা কেবল অলিম্পিয়াড করলাম না। জোর দিলাম বই লেখাতে। এবং কী আশ্চর্য, গত দেড় দশকে শতাধিক গণিতের বই লেখা হয়ে গেল বাংলায়। প্রকাশকেরাও এগিয়ে এলেন। এবং আমরা গণিতের বই প্রকাশনার এক আশ্চর্য জগৎও তৈরি করে ফেলেছি। এখন তো কোনো কোনো গণিতের বই কয়েক বছরে ১০ হাজারের বেশি বিক্রি হয়! এই বইগুলো ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে একদল স্বেচ্ছাসেবী আমাদের শিক্ষার্থীদের বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করল। গড়ে উঠল ম্যাথ ক্লাব, প্যারালাল ম্যাথ স্কুল এবং গণিতের কর্মশালা। বছর বছর এই আয়োজনগুলো বাড়ল জ্যামিতিক হারে। শুধু তাই নয়, গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির ওপর যাতে পুরো চাপ না পড়ে সে জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেদের এলাকায় গণিত উৎসব করতে শুরু করে দিল। এবং এখন অনেক স্কুলের বার্ষিক পরিক্রমায় গণিত অলিম্পিয়াড জায়গা করে নিয়েছে।

এমন একটা বিকাশের জায়গায় আমাদের সাফল্য কেবল বই প্রকাশ বা আইএমওর পদকে সীমাবদ্ধ থাকার কথা নয়। থাকেওনি।

আমাদের শিক্ষার্থীদের আকাশ আমরা বড় করতে শুরু করলাম। নেতৃত্ব দিলেন আমাদের গণিত দলের কোচ মাহবুব মজুমদার। ২০০৮ সালে শুরু হলো আমাদের শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের মিছিল। সেই থেকে প্রতি বছরই আমাদের কেউ না কেউ যোগ দিচ্ছে এমআইটি (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি), হার্ভার্ড, কেমব্রিজ, প্রিন্সটনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছরই এমআইটিতে আমাদের কেউ না কেউ যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, পাস করে যোগ দিচ্ছে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে কিংবা যুক্ত হয়েছে পিএইচডি গবেষণায়। যারা দেশের বাইরে গেল না, তারা দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেদের প্রমাণ করল। প্রথম দিকের গণিত অলিম্পিয়াডের অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই এখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তারিক আদনান মুনের মতো অনেকেই গড়ে তুলেছে তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠান।

আর আমরা নিজেরা আমাদের লক্ষ্য পরিবর্তন করে চলেছি। ২০১৮ সালে সোনার পদক জয়ের পর এ বছর আমাদের লক্ষ্য ছিল সারা দেশের সব জেলাতে এই আয়োজনকে ছড়িয়ে দেওয়া। সেটি হয়েছে। এখন চলছে গণিত ক্যাম্প, শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে আমাদের এই আখড়াকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া।

এসব ছাপিয়ে চলতি বছরেই শুরু হয়েছে প্রায় দুই দশক ধরে গণিত অলিম্পিয়াড প্রস্তুতিতে আমরা যা যা করেছি, সেটিকে সমস্যা সমাধানের একটি সংস্কৃতিতে পরিণত করার কাজ। বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অলিম্পিয়াড পদ্ধতিতে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের গাণিতিক দক্ষতা বাড়ানোর একটি পাইলট প্রকল্প চালু করেছে। এর আওতায় দেশের ১৭টি জেলার ৮০টি স্কুলে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অলিম্পিয়াড পদ্ধতিতে গণিতের শিক্ষায় যুক্ত হয়েছে। এ জন্য প্রতি স্কুলের তিনজন করে মোট ২৪০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কাউন্সিলররা। আর তারই ফলে, আগামী বছর থেকে দেশের সব প্রাইমারি স্কুলে এই পদ্ধতির গণিত শিক্ষা চালু হয়ে যাবে এবং ২০২৩ সালের মধ্যে পুরো প্রাথমিক গণিত শিক্ষাক্রম অলিম্পিয়াড পদ্ধতির আওতায় চলে আসবে।

রূপকথার মতো এসব কিছু সম্ভব হয়েছে একদল তরুণের হাত ধরে। তারুণ্যের শক্তিই তাই গণিত উৎসবের প্রাণ। সেই প্রাণচাঞ্চল্যের প্রতীক ছয় খুদে গণিতবিদ যাচ্ছে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে ইংল্যান্ডের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে, আইএমওর ৬০তম আসরে। সেখানে ১৪ থেকে ২২ জুলাই হবে বিশ্বের মেধার সেরা লড়াই। বাংলাদেশ গণিত দলের জন্য শুভকামনা।

লেখক: প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের প্রধান ও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক

Published at Prothom Alo on July 07, 2019 | https://www.prothomalo.com/we-are/article/1603006/