গণিত কোনো সাবজেক্ট নয়, এটা একটা লাইফস্টাইল

ঘরে ঢুকেই নীরবতাটা টের পাওয়া গেল; পিন পড়লে শব্দ শোনা যাবে, এমন নীরবতা। শব্দদূষণে প্রথম হওয়া এ শহরে এমন নিস্তব্ধতা সত্যি বিরল। ঘটনা হলো পরীক্ষা চলছে। গত ২৯ মার্চের কথা। রাজধানীর লালমাটিয়ায় গণিত অলিম্পিয়াডের ক্যাম্পে নীরবতাই আমাদের স্বাগত জানাল।

গণিত কোনো সাবজেক্ট নয়, এটা একটা লাইফস্টাইল

ঘরে ঢুকেই নীরবতাটা টের পাওয়া গেল; পিন পড়লে শব্দ শোনা যাবে, এমন নীরবতা। শব্দদূষণে প্রথম হওয়া এ শহরে এমন নিস্তব্ধতা সত্যি বিরল। ঘটনা হলো পরীক্ষা চলছে। গত ২৯ মার্চের কথা। রাজধানীর লালমাটিয়ায় গণিত অলিম্পিয়াডের ক্যাম্পে নীরবতাই আমাদের স্বাগত জানাল।

বাইরে নীরব হলে কী হবে, পরীক্ষার্থীদের মাথার ভেতর তখন তুমুল ঝড় চলছে। দরজা দিয়ে কে এল, কে গেল, নজর দেওয়ার সময় কই। মন দিয়ে অঙ্ক কষছিল নুজহাত আহমেদ। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তার গম্ভীর চেহারা আরও গম্ভীর হলো। প্রশ্ন কেমন হয়েছে? এমন ‘কমন’ প্রশ্নের বিপরীতে এল এক শব্দের উত্তর—‘ভালো’। ভালো মানে কি কঠিন? ‘অবশ্যই কঠিন। কঠিন বলেই ভালো।’

গণিত অলিম্পিয়াডের এবারের ক্যাম্পে অংশ নিয়েছিল নুজহাতের মতো গণিতপ্রেমী মোট ৪৩ শিশু-কিশোর। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি প্রতিবছর গণিত উৎসবের আয়োজন করে। ক্যাম্পে অংশ নেয় আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের সেরারা। তবে করোনার কারণে গত দুই বছর অফলাইনে ক্যাম্প হয়নি। এবার আবার ফিরে এসেছে গণিতের সঙ্গে দিন-রাত কাটানোর সুযোগ।

গণিতের ক্যাম্পে সারা দিনের রুটিনটা কেমন, জানতে চাই কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের ছাত্র ইমাদ উদ্দিনের কাছে। ইমাদ বলল, ‘অঙ্ক করি। সমস্যার সমাধান করি মূলত। খাই। রাতে গেম খেলি। ঘুমাই। পরীক্ষা দিই।’ এই ছেলেমেয়েদের গেমের মধ্যেও কিন্তু মিশে আছে গণিত। জানলাম ইমাদের পরের কথায়, ‘আমরা মূলত আইকিউ রিলেটেড গেম খেলি, যে গেমগুলো খেললে লজিক সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পাওয়া যায়। সোজা বাংলায় মাথার জট খোলে। যুক্তি দিয়ে সহজভাবে চিন্তা করতে সুবিধা হয়।’

গেমের মধ্য দিয়েও যে গণিতেরই চর্চা হয়, বোঝা গেল গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কাউন্সিলর সকাল রায়ের কথায়। যেমন আমাদের পরিচিত কাটাকুটি খেলা বা টিক–ট্যাক–টো সম্পর্কে বলছিলেন তিনি, ‘আমরা ছোটবেলায় যেভাবে খাতায় কাটা–গোল্লা খেলেছি, এটা অনেকটা সে রকম। তবে ওরা খেলাটা খেলে আরও নানাভাবে। যেমন সাধারণ নিয়মে যে পরপর তিনটা গোল্লা বা তিনটা কাটা মিলাতে পারে, সে জয়ী হয়। কিন্তু এখানে লজিকটা বদলে উল্টে দেওয়া হয়। ধরুন বলা হলো, যারটা মিলে যাবে, সে হারবে। ফলে দুজনেরই চেষ্টা থাকে যেন মিলে না যায়। এসব খেলার সঙ্গে রাত জেগে দাবা আর সুডোকু মেলানো তো আছেই।’ বোঝা গেল, এদের কাছে গণিত যে শুধু খেলা তা নয়, খেলাটাও গণিত!

ক্যাম্পে ৪৩ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে নারী আছে ৮ জন। তাদেরই একজন জানাল, ক্যাম্পে অংশ নিয়ে গণিতের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গেছে। কীভাবে? উত্তর এল, ‘আগে একটা সমস্যার সমাধান করতে না পারলে হাল ছেড়ে দিতাম। এখন লেগে থাকতে শিখেছি। পাশের জনকে দেখে মনে হয়, ও তো লেগে আছে। আমি হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। আসলে গণিত কোনো সাবজেক্ট নয়, এটা একটা লাইফস্টাইল, সেটা এখানে থেকে বুঝেছি।’

গণিত অলিম্পিয়াড ক্যাম্পের মেন্টর হিসেবে এবারই প্রথম যুক্ত হয়েছেন নিশাত আনজুম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে সদ্য পড়ালেখা শেষ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন তিনি। জানান, এই খুদে গণিতপ্রেমীদের নিয়ে তিনি ভীষণ আশাবাদী। বলছিলেন, ‘শুধু আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে নয়, নিশ্চয় দেশ গড়ার ক্ষেত্রেও ওরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

আইএমও দলের প্রাক্তন সদস্য মুগ্ধ তানজিম ২০১৩ সাল থেকে জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াড ক্যাম্পের মেন্টর হিসেবে যুক্ত আছেন। তিনি মনে করেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড আরও পরিণত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে (আইএমও) অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। ফলে প্রতিবছর নতুন নতুন অভিজ্ঞতা যোগ হচ্ছে। প্রশিক্ষক বাড়ছে। নতুন প্রশ্ন বাড়ছে। তাই গণ্ডিটা আরও বড় হচ্ছে। জাতীয় গণিত ক্যাম্পের সমন্বয় করেছেন গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কোঅর্ডিনেটর সাব্বির রহমান।

এবারের ক্যাম্প নিয়ে গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসানের বক্তব্য, ‘মহামারিকালের থেমে থাকা পেরিয়ে আবার আমরা স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছি। এই ক্যাম্প কেবল গণিত শেখায় না। আরও অনেক কিছু শেখায়। অনেকেই এখানে প্রথমবারের মতো মা-বাবাকে ছাড়া থাকছে। ক্যাম্পে আসার আগের আর পরের মানুষটা ভিন্ন। ক্যাম্পের মাধ্যমেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। কেবল গণিতবিদ হিসেবেই নয়, এই ক্যাম্প তাদের মানুষ হিসেবেও আরও পরিণত করে।’

ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে আইএমওতে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ দল। জাতীয় ক্যাম্পের তত্ত্বাবধানে আছেন বাংলাদেশ গণিত দলের কোচ মাহবুব মজুমদার। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ৬ থেকে ১৬ জুলাই নরওয়ের অসলোতে বসবে ৬৩তম আইএমওর আসর। এবারের আয়োজক অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ। ২০২২ সাল বাংলাদেশের গণিতযাত্রায় একটা বিশেষ বছর হয়ে থাকবে কি না, সময়ই সেটা বলে দেবে।


Written by: জিনাত শারমিন
Published at: Tue, Apr 12, 2022 1:05 PM
Category : BdMO 2022
Share with others