একে ছুটির দিন। তার ওপর মাঘের সকাল। এমন সকালে লেপের ওম ছেড়ে হাজারো শিক্ষার্থী হাজির গণিত উৎসবে। সেখানে খুদে গণিতবিদদের বুদ্ধিদীপ্ত সব প্রশ্ন, গান-গল্পসহ গণিত ও বিজ্ঞানবিষয়ক নানা আয়োজনের ভেতর দিয়ে শেষ হলো ‘ডাচ্-বাংলা-প্রথম আলো গণিত উৎসব, ২০১৭’-এর ঢাকা আঞ্চলিক পর্ব।
উৎসবে উপস্থিত দেশের বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সুধীজনেরা এসব শিক্ষার্থীর মনে গেঁথে দিলেন এক কার্যকর কৌশল। এটি হচ্ছে শুধু প্রতিযোগিতা নয়, গণিতকে আত্মস্থ করতে সবার আগে সেটাকে উপভোগ করা চাই।
গতকাল শুক্রবার ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ প্রাঙ্গণে আয়োজিত এই উৎসবে চার ক্যাটাগরিতে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ১৬৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি এই উৎসবের আয়োজন করে।
চলতি বছর ব্রাজিলে অনুষ্ঠেয় ৫৮তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য বাংলাদেশ গণিত দল নির্বাচনের লক্ষ্যে এবং দেশের শিক্ষার্থীদের গণিতে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এ বছর ১৫টি শহরে আঞ্চলিক গণিত উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সব উৎসবের বিজয়ীরা আগামী ১০ ও ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে অনুষ্ঠেয় জাতীয় গণিত উৎসব, ২০১৭ এবং পঞ্চদশ বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেবে।
গতকাল রেসিডেনসিয়াল কলেজ মাঠে আনন্দমুখর পরিবেশে উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করেন কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া। তিনি বলেন, গণিত এমন একটি বিষয়, যা শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতাকে উসকে দেয়।
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে মনে হয় না একসঙ্গে এত শিক্ষার্থী গণিতবিষয়ক এ রকম একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। শিক্ষার্থীদের গণিতকে উপভোগ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে গণিতে ভালো করার বিকল্প নেই।
গণিতের ডানায় ভর করে এই শিক্ষার্থীরা একদিন সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যাবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন।
গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সহসভাপতি মুহম্মদ জাফর ইকবাল খুদে গণিতবিদদের উৎসাহ দিয়ে বলেন, ‘এখানে তোমরা সবাই মেডেল পাবে না। কিন্তু সবাই বিজয়ী হবে। কারণ এটি উৎসব। আনন্দের ভেতর দিয়ে, উপভোগের ভেতর দিয়ে যে শিক্ষা অর্জিত হয়, সেটাই প্রকৃত শিক্ষা। কিন্তু আমার খুব মন খারাপ হয় যখন দেখি তোমরা গোল্ডেন ফাইভের জন্য প্রতিযোগিতায় নামো।’
শুভেচ্ছা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ঢাকার উৎসবে একসঙ্গে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ একটি রেকর্ড। তিনি আশা করেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় গণিতের এই আলো ছড়িয়ে যাবে।
উদ্বোধনী পর্বে আরও উপস্থিত ছিলেন গণিতবিদ অধ্যাপক লুৎফুজ্জামান, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ ও অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, বিজ্ঞানী ড. রেজাউর রহমান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়াসমিন হক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান প্রমুখ।
উদ্বোধনী পর্বের পর শিক্ষার্থীরা সোয়া ঘণ্টাব্যাপী অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়। এরপর উৎসবে ‘আয় আয় আয়, কে স্বপ্ন দেখবি আয়/ আয় গণিতের আঙিনায়’ গানটির সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে নিত্যরঙের শিল্পীরা। প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বাংলাদেশ গণিত দলের কোচ অধ্যাপক মাহবুব মজুমদার, অধ্যাপক আবদুল হাকিম খান, মনোচিকিৎসক মোহিত কামাল, অধ্যাপক হায়দার খান প্রমুখ। খুদে শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নের জন্য ছিল পুরস্কারের ব্যবস্থা। এ পর্বটি সঞ্চালনা করেন গণিত অলিম্পিয়াডের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলর মাহমুদুল হাসান।
‘তাওয়ায় দিলে রুটি কেন ফুলে ওঠে?’, ‘মাইনাস ১ কে বর্গমূল করা যায় না কেন?’, ‘দুঃখ পেলে চোখে পানি আসে কেন?’, ‘মানুষ কেন বুড়ো হয়?’ খুদে শিক্ষার্থীদের এমন সব প্রশ্নে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন মঞ্চে উপস্থিত বিশিষ্টজনেরা।
প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে বিরতির মধ্যে ছিল শিক্ষার্থী মনন মাহমুদের ওয়াটার রকেট উৎক্ষেপণের পালা। পরে রুবিকস কিউব প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে রবিন নামের এক শিক্ষার্থী। এরপর পাবলিক পরীক্ষায় নম্বর প্রকাশের পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কে অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা।
বিতর্কের আগে কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হক শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘খালি পরীক্ষায় ভালো ফল করলে হবে না। একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে গেলে কবিতা পড়তে হবে, সাহিত্য পড়তে হবে, দর্শন পড়তে হবে। খেলাধুলায় অংশ নিতে হবে।’
সমাপনী পর্বে ১৭৮ জন বিজয়ীর নাম ঘোষণা এবং তাদের পদক ও সনদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় দিনব্যাপী আয়োজন।
এর আগে রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার হাতে ভেন্যু স্মারক ও উপাধ্যক্ষ ফেরদৌস আরার হাতে সুহৃদ স্মারক তুলে দেন আয়োজকেরা। উৎসব উপলক্ষে কলেজ প্রাঙ্গণে বিজ্ঞানচিন্তা, কিশোর আলো, প্রথমা প্রকাশনসহ গণিত ও বিজ্ঞানবিষয়ক বইয়ের স্টলগুলোতেও ছিল উৎসাহী লোকজনের ভিড়। গোটা আয়োজনটি সফলভাবে সম্পন্ন করতে সহযোগিতা করে বন্ধুসভা ও ম্যাথ অলিম্পিয়াড ভলেনটিয়ার্সের সদস্যরা।
শিক্ষার্থীদের কেউ এসেছে পাহাড় ডিঙিয়ে। কাউকে পাড়ি দিতে হয়েছে নদী ও সাগর। পৌষের কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে কুয়াশায় ঢাকা সকালে তারা হাজির কক্সবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে। গণিতের ভয়কে জয় করতে দুর্গম পথ ও ঠান্ডা তুচ্ছ করেছে তারা। পরীক্ষা, প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেওয়া, গান, নাচসহ নানা আয়োজনে দিনভর মেতে ছিল প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী।
গতকাল শনিবার সকাল সোয়া নয়টায় কক্সবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো আঞ্চলিক গণিত উৎসবের। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বুদ্ধিকে পরিপক্ব করে গণিত। মানবসভ্যতায় গণিতের অবদান অনেক। তাই গণিতকে জয় করতে হবে। এ সময় শিক্ষার্থীরা হাত তুলে গণিতকে জয় করার শপথ নেয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা তোলেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কক্সবাজারের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মো. সাজ্জাদুর রহমান। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন কক্সবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. নাছির উদ্দিন।
উদ্বোধনী পর্বে বক্তব্য দেন কক্সবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাম মোহন সেন, কক্সবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. নাছির উদ্দিন। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রথম আলো কক্সবাজারের নিজস্ব প্রতিবেদক আব্দুল কুদ্দুস।
‘গণিত শেখো স্বপ্ন দেখো’ স্লোগানে এই উৎসবের আয়োজক বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় গতকালের এ উৎসবে অংশ নেয় কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৮৫৭ জন শিক্ষার্থী। উদ্বোধন শেষে শিক্ষার্থীরা অংশ নেয় এক ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষায়। এরপর ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বন্ধুসভার সদস্যদের পাশাপাশি উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজন এ আয়োজনে অংশ নেয়।
এরপর ছিল মজার পর্ব—প্রশ্নোত্তর। কারও প্রশ্ন ছিল, মোমবাতির শিখা ওপরের দিকে যায় কেন? কেউবা জানতে চেয়েছে, বোকামির সঙ্গে গণিতের সর্ম্পক কী? শূন্য জোড় নাকি বিজোড়? শূন্য ঋণাত্মক নাকি ধনাত্মক? সময় কেন আপেক্ষিক? খুদে গণিতবিদদের একের পর এক বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে মঞ্চে ছিলেন কক্সবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম ফজলুল করিম চৌধুরী, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আরশাদ চৌধুরী ও নোভা আহমেদ, বদরখালী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ফজলুল হক, কক্সবাজার সরকারি কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান আবদুল কুদ্দুস, প্রভাষক নিজাম উদ্দিন ফারুকী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মফিজুল আলম, কক্সবাজার সিটি কলেজের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক জেবুন্নেছা ও প্রথম আলো যুব কর্মসূচির সমন্বয়ক মুনির হাসান। মজার প্রশ্ন করে পুরস্কার জিতে নেয় শিক্ষার্থীরা।
উৎসবে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা মুখস্থ, মাদক ও মিথ্যাকে ‘না’ বলার অঙ্গীকার করে। বিজয়ী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণের আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে কক্সবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম ফজলুল করিম চৌধুরী বলেন, সবাইকে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ দেশ, এ মাটি আমার—এই চেতনায় শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে।
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি কর্তৃক আয়োজিত ‘ডাচ্-বাংলা ব্যাংক—প্রথম আলো গণিত উৎসব ২০১৭’ এখন সারা দেশের শিক্ষার্থীদের প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে ব্রাজিলে অনুষ্ঠেয় ৫৮তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য
বাংলাদেশ গণিত দলের সদস্যদের নির্বাচনের লক্ষ্যে এ বছর ১৫টি শহরে আঞ্চলিক গণিত
উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এ বছরের আঞ্চলিক পর্ব ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬ শুরু হয়েছে, শেষ হবে ২৭ জানুয়ারির ২০১৭ শুক্রবার।সব আঞ্চলিক উৎসবের বিজয়ীদের নিয়ে আগামী ১০ ও ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ শুক্র ও শনিবার
ঢাকার সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে (আসাদ এভিনিউ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা) অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় গণিত উৎসব ২০১৭।
জাতীয় গণিত উৎসবের তারিখ: ১০ ও ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ শুক্র ও শনিবার
ভেন্যু: সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল,(আসাদ এভিনিউ, মোহাম্মদপুর), ঢাকা।
শীতের কুয়াশা মোড়ানো সকাল। কনকনে বাতাস। কখনো সামান্য সূর্যের ছটা। কখনোবা মুষলধারে বৃষ্টি। রোদ-বৃষ্টির এমন খেলার মধ্যেই আনন্দমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো গণিত উৎসব।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো আঞ্চলিক গণিত উৎসব গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত হয় রংপুর জিলা স্কুল মাঠে। ‘গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো’ স্লোগান সামনে রেখে রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ৫০৭ জন শিক্ষার্থী এ উৎসবে অংশ নেয়।
সকাল নয়টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসব। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন রংপুরের জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক গণিত উৎসবের পতাকা উত্তোলন করেন যথাক্রমে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক রংপুর শাখার ব্যবস্থাপক শিশ মুহম্মদ আবু হানিফা ও রংপুর জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান। এরপর জেলা প্রশাসক বেলুন উড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসবের উদ্বোধন করেন।
উৎসব উদ্বোধনকালে জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার বলেন, গণিতের ভীতি দূর করতে প্রথম আলো দেশব্যাপী গণিত উৎসবের মাধ্যমে আন্দোলন শুরু করেছে। তারা সফলও হয়েছে। প্রমাণ আজকের (গতকাল) এই সকাল। শীতের মধ্যে এই সকালে এত শিক্ষার্থী-অভিভাবকের উপস্থিতি তা প্রমাণ করেছে।
উদ্বোধনী পর্ব শেষে শিক্ষার্থীরা সারিবদ্ধভাবে শ্রেণিকক্ষে চলে যায় গণিত প্রতিযোগিতার পরীক্ষা দিতে। ৯টা ৫০ মিনিট থেকে সোয়া ঘণ্টার পরীক্ষা শেষে স্কুলমাঠের টানানো শামিয়ানার নিচে এসে বসে তারা। এরপর বন্ধুসভার বন্ধুদের পরিবেশনায় গণিতের গান ছাড়া আরও কয়েকটি গান পরিবেশিত হয়।
গান শেষে উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ প্রশ্নোত্তর পর্ব যখন শুরু হবে, ঠিক সেই মুহূর্তে আকাশটা ছেয়ে যায় কালো মেঘে। একটু পর নামে বৃষ্টি। শুরু হয় সবার ছোটাছুটি। আবারও শ্রেণিকক্ষে গিয়ে অবস্থান। এভাবে কাটে দুপুর সাড়ে ১২টা। বৃষ্টি থেমে যায়। তবে সূর্য-মেঘের লুকোচুরি খেলা চলে থেমে থেমে।
এমন লুকোচুরির মধ্যে শুরু প্রশ্নোত্তর পর্ব। ‘চাঁদে লেখার জন্য বিশেষ ধরনের কলম কেন ব্যবহার করতে হয়’, ‘জ্যোৎস্নার আলোতে রং দেখা যায় না কেন?’, ‘আকাশের তারা কেন গণনা করা যায় না’, ‘রাতের বেলা যখন আমরা চলাচল করি তখন আকাশের চাঁদ-তারাও কেন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে যায়’—এমন মজার সব প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের। আর তাদের অনুসন্ধিৎসার জবাবও দেন মঞ্চ থেকে শিক্ষকেরা। মজার প্রশ্ন, মজার উত্তরে জমে ওঠে প্রশ্নোত্তর পর্ব।
প্রশ্নের জবাব দেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুহুল আমিন, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক রুহুল আমিন এবং রংপুর জিলা স্কুলের গণিতের শিক্ষক শফিয়ার রহমান।
প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে প্রাইমারি, জুনিয়র, সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে জয়ী ৮০ খুদে গণিতবিদের গলায় পরিয়ে দেওয়া হয় মেডেল। ছিল টি-শার্টও।
মাঝরাতে বৃষ্টি হয়েছে। সকাল থেকেই ঘন কুয়াশা। সঙ্গে হাড়কাঁপানো শীত। তাতে কী? গণিত উৎসবে প্রতিযোগীদের ভিড় কমেনি একটুও। গরম পোশাক গায়ে চাপিয়ে ঠিক সময়ে রংপুর জিলা স্কুলের মাঠে হাজির সবাই।
আজকের তরুণ প্রজন্ম গণিত জয়ের যে স্বপ্ন দেখছে, তা সত্যি হবেই। গণিত নিয়ে সব ভীতি কাটিয়ে তারা সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাবেই। সেই দিন খুব বেশি দূরে নয়। বগুড়ার বিয়াম মডেল ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে গতকাল শনিবার ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসবের আঞ্চলিক আসর থেকে এমন প্রত্যয়ের কথা শোনা গেল শিক্ষার্থী ও অতিথিদের কণ্ঠে।
রংবেরঙের স্কুল পোশাক পরে আসা সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর হইচই আর উল্লাসে মুখরিত হয়ে উঠেছিল কলেজ চত্বর। তাদের মুখরতা কনকনে শীতের সকালে উৎসবে আসা অতিথি ও অভিভাবকদেরও যেন ছুঁয়ে গিয়েছিল। উৎসবে বগুড়া ছাড়াও জয়পুরহাট, গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জ জেলার শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির আয়োজনে এবং প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় এ অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক ডাচ্-বাংলা ব্যাংক।
সকাল নয়টায় সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে উৎসব শুরু হয়। বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. আশরাফ উদ্দিন জাতীয় পতাকা, বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. মুস্তাফিজুর রহমান জাতীয় অলিম্পিয়াডের পতাকা এবং ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের বগুড়া শাখার ব্যবস্থাপক ফজলুল কবির আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন। পরে বেলুন উড়িয়ে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন জেলা প্রশাসক।
গণিত শেখার প্রতি শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিয়ে জেলা প্রশাসক মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, গণিত নিয়ে একসময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক ছিল। এখন তা ভীতির বিষয় নয়। শিক্ষার্থীরা আনন্দ নিয়ে এই গণিত উৎসবে যোগ দিচ্ছে। ভীতি কাটিয়ে এই বিষয়টি শিক্ষার্থীদের কাছে সহজ করে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা পালন করছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো। গণিত জয়ের স্বপ্ন একদিন সত্যি হবেই।
জেলা প্রশাসক বলেন, যারা সেরা তারা কখনো মাদক নেয় না। মিথ্যা বলে না। দুর্নীতি করে না। আর সেরা মেয়েরা কখনো বাল্যবিবাহে রাজি হয় না।
এরপর গণিতের ওপর ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের মূল্যায়ন পরীক্ষা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। বগুড়ার আমরা কজন শিল্পীগোষ্ঠীর নৃত্যশিল্পীরা অনুষ্ঠানে দুটি নাচ পরিবেশন করেন। সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লাবণ্য ও তার দল গণিতের গান গেয়ে শোনায়। এরপর শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। এ পর্ব সঞ্চালন করেন জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াড দলের মাহমুদুল হাসান সোহাগ। শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক লায়েক সাজ্জাদ এন্দেল্লাহ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক খায়রুল আলম, সরকারি আজিজুল হক কলেজের গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলম মণ্ডল, রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারুক আহমেদ এবং পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক মাহফুজুর রহমান। এ পর্বে শিক্ষার্থীদের মাদক, মিথ্যা ও মুখস্থকে ‘না’ বলে শপথ করান মাহমুদুল হাসান। অতিথিদের বক্তব্য ও আঞ্চলিক পর্বে বিজয়ীদের হাতে পদক তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।
অতিথির বক্তব্যে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের বগুড়ার ব্যবস্থাপক ফজলুল কবির বলেন, গণিত শিখে জীবন সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে। দেশের জন্য কাজ করতে হবে।
বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সুন্দর আগামীর জন্য শিক্ষার্থীদের আলোকিত মানুষ হতে হবে। গণিত জয়ের এই চ্যালেঞ্জের জন্য শিক্ষার্থীদের নিজেকে তৈরি থাকতে হবে। গণিত জয়ের মাধ্যমে বিশ্বকে জয় করতে হবে।’
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক খায়রুল আলম, প্রথম আলোর বগুড়ার অফিস ব্যবস্থাপক শরিফুল ইসলাম ও আঞ্চলিক বিক্রয় নির্বাহী জাকির হোসাইন বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠান শেষে প্রাথমিক ক্যাটাগরিতে ১৬, জুনিয়র ক্যাটাগরিতে ১৩, সেকেন্ডারিতে ১৫ এবং হায়ার সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে ১৫ জনসহ মোট ৫৮ জনকে বিজয়ী ঘোষণা করে তাদের হাতে মেডেল, টি-শার্ট ও ঢাকার চিঠি তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মুস্তাফিজুর রহমানের হাতে তুলে দেওয়া হয় ভেন্যু স্মারক।
পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ি গতকাল ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ সকাল থেকে ঢাকা আঞ্চলিক গণিত উৎসবের রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম শুরু হয়। রেজিস্ট্রেশন শুরুর দ্বিতীয় দিন অাজ ২৪ ডিসেম্বর ‘আগে এলে আগে’ ভিত্তিতে নির্ধারিত সংখ্যক শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।