এশিয়া প্যাসিফিক ম্যাথমেটিক্যাল অলিম্পিয়াডের (এপিএমও) ২৭তম আয়োজন গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এপিএমওর সদস্য সব দেশে একযোগে অনুষ্ঠিত হয় পৃথিবীর এই সর্ববৃহৎ আঞ্চলিক গণিত অলিম্পিয়াড। এতে বাংলাদেশের ৬৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন।
ভৌগোলিক অবস্থান ও সময়ের ব্যবধানের কারণে দেশভেদে অলিম্পিয়াড আয়োজন ভিন্ন সময়ে হয়েছে। বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত হলেও এপিএমওর পরীক্ষা হয় অভিন্ন প্রশ্নে। অলিম্পিয়াডে গণিতের পাঁচটি সমস্যা সমাধানের জন্য চার ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। প্রতিটি প্রশ্নের সর্বোচ্চ মান সাত। অংশ নেওয়া সব শিক্ষার্থীর উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে মেধাক্রম নির্ধারণ করা হবে। প্রথম ১০ জনের ফলাফল এবং নমুনা হিসেবে প্রথম, তৃতীয় ও সপ্তম স্থান অধিকারীর উত্তরপত্র কাজাখস্তানে পাঠানো হবে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এপিএমওতে সারা দেশ থেকে আসা প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে এপিএমওর আয়োজন করে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। এতে উপস্থিত ছিলেন কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান, সমন্বয়ক বায়েজিদ ভূইয়া ও আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে রৌপ্য পদকপ্রাপ্ত নূর মোহাম্মদ শফিউল্লাহ।
মাঘের সকাল৷ টানা অবরোধ৷ কোনো কিছুই আটকে রাখতে পারেনি ওদের৷ গণিতের প্রতি ভালোবাসার টানে, সব বাধা উপেক্ষা করে খুদে গণিতবিদেরা জড়ো হয়েছিল ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ প্রাঙ্গণে, ঢাকা আঞ্চলিক গণিত উৎসবে। ‘গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো’ স্লোগানের উৎসবে এসে তারা জয় করল গণিতভীতি, দেখল দেশ গড়ার স্বপ্ন৷
গতকাল শুক্রবার ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি আয়োজন করে এই উৎসবের।
দিনভর গণিতের নানা বিষয়ের পাশাপাশি ভালো মানুষ হওয়ার, দেশকে এগিয়ে নেওয়ারও শিক্ষা পায় এই শিক্ষার্থীরা৷ উৎসবের গান ‘আয় আয় আয়, কে স্বপ্ন দেখবি আয়। আয় গণিতের আঙিনায়। কে দেশটা গড়বি আয়’—যেন সার্থকতা পায় এসব খুদে গণিতবিদের উচ্ছল অংশগ্রহণে৷
সকাল নয়টার আগেই অনুষ্ঠানস্থল মুখর হয়ে ওঠে খুদে গণিতবিদদের পদচারণে৷ সাড়ে নয়টায় জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় গণিত উৎসব। রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সুবহানি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুল হাসান। পতাকা উত্তোলনের পর অতিথিরা বেলুন উড়িয়ে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধনী অধিবেশনে জামিলুর রেজা চৌধুরী এই উৎসব ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে করার কথা বললেন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের গণিতভীতি দূর হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তারা যে বিশ্বমানের, সেটা প্রমাণ করছে।
গণিতকে ভয় নয়, ভালোবেসে জয় করার মন্ত্র সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানালেন জামিলুর রেজা চৌধুরী।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর পক্ষে সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন।
এরপর সকাল ১০টায় গণিত উৎসবের লিখিত পরীক্ষা শুরু হয়ে চলে বেলা সোয়া ১১টা পর্যন্ত। পরীক্ষা শেষে খুদে গণিতবিদেরা আবারও মাঠে এসে জড়ো হয়। গণিত উৎসবের গান দিয়ে শুরু হয় উৎসবের এ পর্ব। এরপর শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। গণিত ও বিজ্ঞানবিষয়ক বই দিয়ে সাজানো বইমেলা উৎসবে বিশেষ মাত্রা যোগ করে।
গাড়ি বা ট্রেনে করে যাওয়ার সময় কয়েন ওপরে ছুড়ে দিলে তা সেখানেই ফিরে আসে কেন? সর্ববৃহৎ মৌলিক নাম্বার কোনটি? পিত্তথলি, কিডনিতে পাথর হয় কীভাবে? গণিত উৎসবে এসে অংশগ্রহণকারীরা বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে প্রশ্ন করে।
খুদে গণিতবিদদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, গণিতবিদ অধ্যাপক খোদাদাদ খান, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী রেজাউর রহমান, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক লায়েক সাজ্জাদ এন্দেল্লাহ, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম, আনিসুল হক প্রমুখ। প্রশ্নোত্তরের এ পর্বটি সঞ্চালনা করেন গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কাউন্সেলর মাহমুদুল হাসান।
উত্তরা থেকে বাবার সঙ্গে উৎসবে আসে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ৷ সে বলল, ‘ম্যাথ করতে আমার ভালো লাগে৷ একদিন আমিও আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে যাব৷’
উৎসবে উপস্থিত ছিলেন রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ফেরদৌস আরা বেগম, অধ্যাপক লুৎফুজ্জামান, গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সহসভাপতি মুনিবুর রহমান চৌধুরী, সদস্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, বুয়েটের অধ্যাপক আবদুল হাকিম খান ও ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, এস সোহরাবউদ্দীন, বাংলাদেশ গণিত দলের কোচ মাহবুব মজুমদার, সেন্ট যোসেফ কলেজের শিক্ষক দীপক কুমার সরকার, একাডেমিক কাউন্সেলর তামিম শাহরিয়ার প্রমুখ।
নিজের ছেলে ও ভাগনেকে নিয়ে উৎসবে এসেছিলেন ইকবাল আহমেদ৷ বললেন, ‘পুরস্কার পাওয়া না-পাওয়া বড় ব্যাপার নয়৷ ছেলেমেয়েরা এত ছোট বয়স থেকেই অঙ্কের ভয় কাটিয়ে মজা নিয়ে শিখতে শুরু করছে, এটাই আসল৷ ব্যাপারটা আরও তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হবে৷’
মধ্যাহ্ন বিরতির পর আবারও অনুষ্ঠান শুরু হয় বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির ওয়াটার রকেট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে। এর পরই হয় রুবিকস কিউব প্রতিযোগিতা। মাত্র ১১ দশমিক ১ সেকেন্ডে কিউব মিলিয়ে এতে চ্যাম্পিয়ন হয় সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের সাকিব ইবনে রশীদ ঋভু।
৫০ ও ৫১তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের হয়ে ব্রোঞ্জ পদকজয়ী নাজিয়া চৌধুরী ও তারিক আদনান খুদে গণিতবিদদের তাঁদের সফলতার গল্প শোনান।
বেলা তিনটায় শুরু হয় ফলাফল ঘোষণা। এর আগে গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান জানিয়ে দেন, ঢাকা অঞ্চলের এবারের আয়োজনে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও ঢাকার ১৫৪টি স্কুলের ৩ হাজার ১৫৭ জন শিক্ষার্থী নিবন্ধন করে। তার মধ্যে গতকালের উৎসবে উপস্থিত ছিল ২ হাজার ৫২৭ জন। ঢাকা উৎসবে প্রাইমারি, জুনিয়র, সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি—এই চারটি ক্যাটাগরিতে শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। উৎসব সফল করার জন্য কাজ করেছেন প্রথম আলো বন্ধুসভা এবং ম্যাথ অলিম্পিয়াড ভলান্টিয়ার্সের (মুভার্স) ৩০০ স্বেচ্ছাসেবক।
ফলাফল ঘোষণার আগে আনিসুল হক বলেন, অংশগ্রহণকারীরা প্রশ্নোত্তর পর্বে যেসব প্রশ্ন করেছে, সেই প্রশ্নগুলো উত্তরসহ কিশোর আলোয় ছাপা হবে।
অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে ১৬৬ জনকে পুরস্কৃত করা হয়। এই ১৬৬ জন দেশের আরও ২৩টি আঞ্চলিক গণিত উৎসবে বিজয়ীদের সঙ্গে ৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আসাদগেটসংলগ্ন সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে অনুষ্ঠেয় জাতীয় গণিত উৎসব ও ত্রয়োদশ বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেবে।